বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান এটিআই লিমিটেড, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, লোডিং আনলোডিং লেবার এবং সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আমদানি-রপ্তানিকারকদের দ্বন্দ্বের কারণে ৯ দিন ধরে পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।
সংকট নিরসনে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসনের আহ্বানে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও চালু হয়নি বন্দরটি। এতে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এর ফলে উভয় পাশে আমদানি-রপ্তানি কাজে নিয়োজিত চতুর্দেশীয় শত শত পণ্যবাহী ট্রাক আটকে পড়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে পরিবহণ শ্রমিক, লোড আনলোডিং শ্রমিক, ব্যবসায়ীসহ স্থলবন্দর সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে লেবার হ্যাল্ডেলিংয়ের জন্য ইজারাদার নিয়োগের পর থেকেই মাঝে মাঝেই অস্থির হয়ে উঠছে চর্তুদেশীয় (বাংলাদেশ, ভারত, নোপাল ও ভুটান) ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্ভানাময় স্থলবন্দরটি।
বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্ব আর শ্রমিক অসন্তোষের জেরে কয়েক দিন পর পরই বন্ধ হয়ে যায় আমদানি রপ্তানি কার্যক্রম। চলমান সংকট নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ দায়ী করছেন ব্যবসায়ীদের আর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা দায়ী করছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং লেবার লোড আনলোডিংয়ের ইজারা প্রতিষ্ঠান এটিআই লিমিটেডকে। তবে স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট সুবিধা সচল আছে।
বাংলাবান্ধা স্থবন্দরের কুলি শ্রমিক শাহা আলম বলেন, ‘বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সুন্দরভাবেই চলছিল কিন্তু এটিআই লিমিটেড লেবার হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বন্দরে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এখন আমরা সবাই এই যন্ত্রণা ভোগ করছি। দুদিন পর পরই বন্দর বন্ধ হয়ে যায়। এতে আমরা শ্রমিকরা খুব মুশকিলে পড়ে গেছি। আমাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে গেছে।’
স্থলবন্দরের শ্রমিক এঝারুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আগে যেই রেটে কাজ করতাম হঠাৎ করে সেটা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা বকেয়া টাকা চাইতে গেলে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে আমাদের নামে মামলা দিচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।’
বন্দরের ব্যবসায়ী আহসান হাবিব বলেন, ‘বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে লোড আনলোড বাবদ ১০৪ টাকা করে নিলেও আমাদের কোনো পণ্যই লোড করে দিচ্ছে না। লোড আনলোডের টাকা আমরা যদি বন্দরকেও দেই আবার শ্রমিকদেরও দেই তাহলে আমরা ব্যবসায়ীরা যাবো কোথায়। আমরা ব্যবসায়ীরা চরম সংকটে পড়ে গেছি। একমাত্র সরকার সুদৃষ্টি দিলে বন্দর বাঁচবে আমরা ব্যবসায়ীরা বাঁচবো।’
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারক সাইদুর রহমান ও নাসিমুল হাসান নাসিম বলেন, ‘এখানে সরকারি রাজস্ব প্রদানসহ সকল বিধিমালা মেনেই ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানি করতে চায়। আমাদের নানা হিসেব দেখিয়ে এটিআই লিমিটেড ২/৩ টাকা মুনাফার কথা বলছে। কিন্তু এটিআই লিমিটেড শুধু আমদানিকৃত পাথর থেকেই প্রতিদিন ২ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করছে। এছাড়া অন্য পণ্য তো রয়েছে। লেবারদের কথা চিন্তা করে তারা আরেকটু ছাড় দিলে বন্দরটি আবারও সচল হয়ে উঠবে।’
আমদানিকারক হারুন উর রশিদ বাবু বলেন, ‘বন্দর পরিচালনায় অযোগ্য প্রতিষ্ঠান এটিআই লিমিটেডকে বন্দরটির লেবার হ্যান্ডেলিং এর ইজারা প্রদানের পর থেকেই এখানে অচলাবস্থা শুরু হয়। কয়েক মাস ধরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বারবার ব্যহত হচ্ছে। ইজারাদার প্রতিষ্ঠান এবং কুলি শ্রমিকদের দ্বন্দ্বের কারণে বারবার ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। মূলত একটি চক্র সম্ভাবনাময় বাংলাবান্ধা বন্দরটি অচল করার ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এখানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এখানকার ব্যবসা বাণিজ্য আরেকটি বন্দরে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত করছে ওই চক্রটি।’
লেবার হ্যান্ডেলিং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এটিআই লিমিটেডের পার্টনার প্রতিনিধি মেহেদী হাসান খান বাবলা বলেন, ‘লেবার হ্যান্ডেলিং চুক্তি মোতাবেক এটিআই লিমিটেড কাজ করছে। জেলা প্রশাসনের আহ্বানে একাধিক বৈঠনে কুলি শ্রমিকের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের হিসেব সঠিক নয়। সব কিছু পরিশোধের পর আমাদের ২/৩ টাকাও মুনাফা থাকে না। মূলত কয়েকজন সিএন্ডএফ এজেন্ট এবং আমদানিকারকের কাছে বন্দরের বকেয়া পাওনা চাওয়ার কারণে তারা নানান কথা বলছেন। সরকারি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে নিয়মনীতি মেনে আমদানি-রপ্তানি পরিচালনা করা গেলে এখানে কোনো সমস্যা থাকবে না।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর লিমিটেডের ব্যবস্থাপক মামুন সোবহান বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মিটিং হয়েছে। আমরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকারি ট্যারিফের প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ টাকা পাব। গত ১ তারিখে যে ১০৩টি ট্রাক ঢুকেছে সেখানে আমরা বকেয়ার কথা বলিনি, আমরা বলেছি এই ১০৩টি ট্রাকের সরকারি ট্যারিফ পরিশোধ করলে পণ্য খালাস করা হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা আগে সেবা চায়, টাকা পরে। যার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর শ্রমিকরা ১৪ লাখ টাকা পেয়েছে, তারা আরো ৯ লাখ টাকা দাবি করে। ১৯ টাকা রেট ধরলে তারা তো আর কোনো টাকা পায় না। বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত আছে শুধু আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে না।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মোহম্মদ জহিরুল ইসলাম জানান, ‘সংকট সমাধানে আহ্বান করা জরুরি বৈঠকে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও সিএন্ডএফ এজেন্টরা না এসে ঠিক করেননি। সরকারি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে প্রয়োজনে তাদের নিয়ে আবারও বৈঠক করা হবে। আশা করা হচ্ছে সব পক্ষকে নিয়ে ঐক্যমতের ভিত্তিতে এবং নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই শিগগির বন্দরটি সচল করা হবে।’